উত্তাপ বাড়ছে গাজীপুরে

আগামী ২৬ জুন গাজীপুর সিটিতে ভোট উৎসব। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, উত্তাপ বাড়ছে গাজীপুর সিটিতে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও। সেই সঙ্গে প্রার্থীরাও অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ করছেন নির্বাচন কমিশনে। দেশের সর্ববৃহৎ এই সিটির নগরপিতা কে হবেন—তা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। গতকাল দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রশাসনিক হয়রানি করার অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী। এ বিষয়ে তিনি নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা দাবি করেছেন, তারা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ঠিক রাখতে পেরেছেন।

নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, গাজীপুরে ভোটের উত্তেজনার কাছে বিশ্বকাপ ফুলবলের উত্তেজনাও যেন হার মেনেছে। প্রার্থীদের পাশাপাশি ভোট নিয়ে উত্তেজনা চলছে ভোটারদের মধ্যেও। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন প্রত্যাশা করেছেন সবাই।

প্রচারণায় কর্মী বেশি আওয়ামী লীগের : দলীয় মেয়র প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের কর্মী কেউ বসে নেই। তবে ভোটের প্রচারণায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের বেশি মাঠে দেখা যাচ্ছে। এদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী মো. জাহাঙ্গীর আলম গতকাল নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ড ডুয়েট ফটকের সামনে পথসভার মাধ্যমে গণসংযোগ শুরু করেন। দুুুপুরে মহানগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ড হাড়িনাল এলাকার পথসভায় মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রত্যেক প্রার্থীরই ভোটারের ওপর শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত, সম্মান থাকা উচিত। গাজীপুরে সবসময় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। গাজীপুর মডেলে নির্বাচন চাই। ভোটারদের বিশ্বাস করি। মানুষ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারবে। তিনি ২৬ জুন নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানান।

পথসভায় খুলনা সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ওপর আস্থা রেখে খুলনার মানুষ বিপুল ভোটে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করেছে। গাজীপুরেও নৌকার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করতে আগামী ২৬ জুন নির্বাচনে নৌকা মার্কায় ভোট দিন। এ ছাড়া তিনি বিএডিসি, পূর্ব ভুরুলিয়া, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের শিমুলতলী, চতর বাজার, ভানুয়া, ফাওকাল, চাপুলিয়া, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ছায়াবিথী শ্মশান মোড়, টাংকিরপাড় মোড়, জোড় পুকুরপাড়, বরুদা, হাড়িনাল, লেবু বাগান, দক্ষিণ ছায়াবিথী মোড়, মাধবাড়ি মোড়, রথখোলা, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিলাশপুর মসজিদের সামনে, মাড়িয়ালী, নিয়ামত সড়ক, শহীদ স্মৃতি স্কুল, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে, তালুকদারের পুকুর পাড়, কৃষি গবেষণা শ্রমিক ক্লাব, কাজীবাড়ি, পূর্ব চান্দনা, ভোড়া কুমারপাড়া, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ভাড়ারুল জামতলা, চৌরাস্তা, ধীরাশ্রম, পুবাইল কলেজ গেট, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে মাঝুখান বাজার, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে হায়দারাবাদ মাদ্রাসার সামনে পথসভা এবং গণসংযোগ করেন।

ইউকে এবং ইউএসএ ডিপ্লোমেটদের সঙ্গে বৈঠক : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম দুপুরে চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয়ে ইউকে এবং ইউএসএ ডেভেলপমেন্ট প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এ সময় নির্বাচনী প্রচারণার পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচারণা : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে বিজয়ী করতে মহানগরীর ৩, ৪, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিমপুর এলাকায় গতকাল দিনভর গণসংযোগ ও প্রচারণায় অংশ নেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল আলম আসকরসহ স্থানীয় নেতারা। এদিকে নগরীর ২৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, অ্যাডভোকেট কাজী মোরশেদ কামাল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাছাড়া ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের খাইলকুর এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিল, এস এম কামাল প্রমুখ নেতারা মতবিনিময় এবং গণসংযোগ করেন।

গাজীপুর মহানগর যুবলীগের উদ্যোগে চান্দনা চৌরাস্তা সংলগ্ন সাগর সৈকত কনভেনশন সেন্টারে মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেলের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মো. হারুনুর রশীদ, মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সেলিম আজাদ প্রমুখ। এদিকে সকালে সিটির চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ হল রুমে ১৪ দলীয় জোটের নেতারা স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মো. রেজাউর রশীদ খান, গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসাইন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আফজাল হোসেন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান প্রমুখ।

নেতা-কর্মীদের হয়রানির অভিযোগ বিএনপির : গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি তথা ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের হয়রানি, গ্রেফতার ও হুমকি-ধমকি বন্ধে বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডলের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। গতকাল সকালে তিনি এ আবেদনটি রিটার্নিং কর্মকর্তার হাতে তার কার্যালয়ে জমা দেন। জানা গেছে, বিএনপি প্রার্থীর সমর্থকদেরকে ভোট অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখতে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও মিথ্যা মামলা দায়েরসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। গত বুধবার রাতে বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ৯ জনকে বিনা কারণে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে হাসান সরকার দাবি করেছেন। ওই আবেদনে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের তালিকা ধরে পুলিশ গ্রেফতারের চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করা হয়। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল বিএনপির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে জানান, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সমুন্নত রাখা হয়েছে।

এদিকে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার গতকাল সকালে তার টঙ্গীর বাসভবনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল টিমের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এ সময় নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেন ডেলিগেট ও বিএনপির প্রার্থী। মতবিনিময় শেষে হাসান উদ্দিন সরকার সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনী মাঠ সুষ্ঠু না হলে এবং গ্রেফতারকৃত নেতা-কর্মীদের ছেড়ে না দেওয়া হলে, এমনকি নির্বাচন কমিশন বুধবার যে মতবিনিময় সভা করেছেন সেখানে সবাই যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হলে দলীয়ভাবে বা আমি এককভাবে কঠোর সিদ্ধান্ত নেব। পরে তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেন।

গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় কোনাবাড়ী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পথসভার মধ্য দিয়ে হাসান সরকার গণসংযোগ শুরু করেন। পরে কাশিমপুর এলাকায় পথসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, বুধবার নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাতে আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু ইসির দেখানো এই স্বপ্ন মাত্র ৬ ঘণ্টার মধ্যেই যে দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে তা গাজীপুরের জনগণ কল্পনাও করেনি। তিনি বলেন, সব ধরনের ভয়ভীতি ও গ্রেফতার বন্ধ করে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় গাজীপুরের জনগণ এই নির্বাচন মেনে নেবে না এবং এর খেসারত নির্বাচন কমিশন ও সরকারকেই দিতে হবে।

২০-দলীয় জোটের ৫৭ টিম : বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে নগরীর ৫৭টি ওয়ার্ডে বিএনপির কেন্দ্রীয় ৫৭টি টিম নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে। এসব টিম তাদের নির্ধারিত ওয়ার্ডে ইতিমধ্যে প্রচারণা শুরু করেছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সালনা এলাকায় গণসংযোগ করেন।